প্রতীপ কুমার দত্ত: লেখাটা যখন লিখছি তখন ৭ নভেম্বার ২০১৮। বিশ্বাস করুন আজ মধ্যরাত পর্যন্ত বেশ দুশ্চিন্তায় থাকবো! হঠাৎ করে যদি আবার সেই কন্ঠস্বর শোনা যায়, “মিত্রো…”; ঠিক যেমনটা শোনা গিয়েছিল দুবছর আগে, আর এক লহমায় বাতিল হয়ে গিয়েছিল পুরোনো যত ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট! তারপর? বেশ কয়েকটা মৃত্যু, রাজনৈতিক বাদানুবাদ, ব্যাহত ব্যাংকিং পরিষেবা, এলডোরাডো খুঁজে পাবার মত টাকাভর্তি এ টি এম যন্ত্র খুঁজে ফেরা, সোশাল মিডিয়ায় ঝড়, ১০০ টাকার নোট নিয়ে কালোবাজারী, মেয়ের বিয়ে বন্ধ, চিকিৎসা স্তব্ধ, বাজারের মাছি তাড়ানো, দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হারে প্রবল আঘাত, কর্মসংস্থান কমে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।
মিথ্যাচারকে এমনভাবে বিপুলকায় করতে হবে যাতে সাধারণ মানুষের নিজস্ব যুক্তিবোধ খর্বকায় ও অকিঞ্চিতকর হয়ে পড়ে – গোয়েবলীয় তত্ত্বের মূল সুর ছিল এটাই তাই না? নোট বাতিলের নীতি ঘোষিত হবার পর, এ টি এম কাউন্টার আর ব্যাঙ্কের সামনে দীর্ঘ সর্পিল লাইনে দাঁড়িয়ে, সাধারণ মানুষের যুক্তিবোধ খর্বকায় আর অকিঞ্চিতকর হয়ে পড়েছিল কিন্তু তারা অনাগত দুর্নীতিমুক্ত ‘আচ্ছে দিনের’ আশায় নোট বাতিলের হয়রানিকে মেনে নিয়েছিল!
তারপরেও সরকারি প্রতারণার রুদ্ধশ্বাস অভিঘাতকে বুকে নিয়ে সাধারণ মানুষ, ‘আম আদমী’, উত্তরপ্রদেশসহ বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনে শাসক দলকে বিপুল ভোটে জিতিয়েছে। কিন্তু আজ কিছু কট্টর ‘রামপন্থী’ ছাড়া বাকী সবাই পড়ে ফেলেছে নোট বাতিলের ফলে অর্থনীতির সর্বনাশের খতিয়ান। সাম্প্রতিক শিল্পবৃদ্ধির হার তলানীতে, সেন্টার ফর মনিটারিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির রিপোর্ট অনুযায়ী মাত্র ৪.৬%। মনে রাখতে হবে এই হার ৩% বা তার তলায় নামলেই ধরে নিতে হবে যে, ভারতীয় অর্থনীতি মন্দাবস্থাতে প্রবেশ করেছে। আর এই মন্দা থেকে বাঁচতেই বোধহয় কেন্দ্রীয় সরকার রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে ঋণনীতি শিথিল করতে বলছে বা বিপুল অঙ্কের অর্থ দাবী করছে। ২০১৯ এর সাধারন নির্বাচনের আগেই মন্দা চলে এলে, স্বয়ং গোয়েবলস নরক থেকে নেমে এসে বিজেপির হয়ে প্রচার চালালেও তাকে বাঁচাতে পারবে বলে মনে হয় না!
আন্তর্জাতিক বাজারে টাকার দাম ক্রমাগত নিম্নমুখী অথচ ভারতের রপ্তানী গত বছরের তুলনায় ২.২% কমেছে। গোদের ওপর বিষফোড়া, এই বছর বর্ষা ভালো হয়নি। হিসাব বলছে, গত বেশ কয়েক বছরের গড়ের তুলনায় বৃষ্টিপাত ৯.৪% কম হয়েছে। ফলে শিল্পপণ্যের আভ্যন্তরিন চাহিদা বেশ খানিকটা কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েই গেছে। অথচ অর্থনীতির পন্ডিতরা বলছেন যে, ঠিক যে সময়টাতে নোট বাতিলের নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল, সেই সময় বিশ্বের প্রায় সব দেশেরই অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার বেশ ভালো ছিল কিন্তু নোট বাতিলের মত অনাবশ্যক অর্থনৈতিক হটকারিতা বিশ্ব অর্থনীতির সেই সুদিনের সুযোগ নিতে ব্যর্থ হল।
আচ্ছা এবার ধরে নিন, নোট বাতিলের সবকটা উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। দেশে এখন আর কোন কালো টাকা নেই, জাল নোটের কারবারিরা সব জেলে, সীমান্তপারের সন্ত্রাসীরা ‘বন্দুক নয় গোলাপের তোড়া হাতে কূচকাওয়াজ’ করে প্রতিদিন। সর্বোপরি, অর্থনীতির একটা বড় অংশ ডিজিটাল হয়ে যাওয়ায় দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার বা ‘গ্রোথ’ খুব বেশী। ‘আচ্ছে দিনের প্রতিশ্রুতিটা তো সংক্ষেপে এটাই! এবার বলুন তো, এমনটা হলে আমার আপনার মত আম আদমির কী লাভ হবে?
আসলে এই জাতীয় প্রতিশ্রুতির মধ্যেই আছে সেই বিপুলাকায় মিথ্যাচার আর সাধারণের যুক্তিবোধকে খর্ব করার ঐতিহাসিক প্রয়াস। প্রয়াসটা ঐতিহাসিক কারন এই মিথ্যাচারের ট্র্যাডিশান বহু বহু বছর ধরে সমানে চলছে! ‘গরিবী হটাও’, ‘সাইনিং ইন্ডিয়া’ বা ‘আচ্ছে দিন’ – স্লোগানগুলো আলাদা কিন্তু গল্পটা একই – অর্থনৈতিক বৃদ্ধি (গ্রোথ) আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফারাকটাকে ভুলিয়ে দিয়ে পুঁজির বিকাশের জন্য অবাধ ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। উন্নয়ন আর বৃদ্ধি সমার্থক হলে, আজকের বহুল বিজ্ঞাপিত পুঁজিকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক বৃদ্ধির পরেও, কী কারনে এই দেশে সম্পদ ও আয় বন্টনে বিপুল অসাম্য টিঁকে থাকে? কীভাবে এখনও এদেশের কোটি কোটি শিশু রাত্রে খিদে চেপে ঘুমাতে যায়?
আসলে আর্থিক বৃদ্ধিকে পাখীর চোখ করা অর্থনৈতিক তত্ত্ব, চরিত্রগতভাবেই এই ধরণের অর্থনৈতিক অসাম্যকে মেনে নেয়। বহু চর্চিত কিন্তু প্রচন্ডভাবে ভ্রান্ত ‘চুঁইয়ে পড়া তত্ত্বকে’ আঁকড়ে ধরে বার বার প্রমাণ করার চেষ্টা হয় যে, ক্রমাগত পুঁজিকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক বৃদ্ধিই হল সেই মিডাসের ছোঁয়া যা আম আদমীর সমৃদ্ধি আনবে, স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও যা অধরাই থেকে গেছে কিন্তু ‘আম আদমী’ গোয়েবলসের গোশালাতে আজও অপেক্ষায় আছে।
দেখে নেওয়া যাক এই ‘চুঁইয়ে পড়া তত্ত্বটি’ কী! খুব সহজে এই তত্ত্বটিকে বোঝার জন্য একটা গল্প বলা যাক। ধরা যাক কোন গোপালক তার আদরের গরুটিকে অতিরিক্ত ভুষি খেতে দিল। এখন এই ভুষির খানিকটা অংশ গরুটি খেতে খেতে মাটিতে ছড়ালে সেই ছড়িয়ে পড়া ভুষি কাক শালিকেও খেতে পারবে! চুঁইয়ে পড়া তত্ত্বে ধরে নেওয়া হয় যে, বিনিয়োগকারীরা, সঞ্চয়কারীরা বা বড় বড় শিল্প-কারখানার মালিকেরাই অর্থনীতির আসল চালিকাশক্তি। এদের সমৃদ্ধি ঘটলে, সেই সমৃদ্ধি কালক্রমে চুঁইয়ে চুঁইয়ে সমাজের বাকী অংশে বিশেষত শ্রমিকশ্রেনীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। এই বিনিয়োগকারীর, সঞ্চয়কারীর বা বড় বড় শিল্প-কারখানার মালিকদের সমৃদ্ধির স্বার্থে এই শ্রেনীর জন্য নানারকম সুযোগ-সুবিধার প্রেসক্রিপশানও দেওয়া হয় এই তত্ত্বে। গল্পের গরুটি হল বিনিয়োগকারী, সঞ্চয়কারী বা কারখানার মালিকশ্রেনী আর কাক শালিক হল দেশের আম আদমী।
কিন্তু মুশকিলটা হল গল্পের গরুটি স্বভাবে বেশ স্বার্থপর। কাক শালিক তার উচ্ছিষ্ট ভুষি খেতে গেলেই সে শিং বাগিয়ে তেড়ে আসে, কাউকে ভাগ দেয় না। সমাজের অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ শ্রেনী আরও সমৃদ্ধ হলে, তাদের সেই সমৃদ্ধি সুইস ব্যাঙ্কের মত নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে সংরক্ষিত হয়, দেশের আম আদমী তার ভাগ পায় না।
তাও অর্থনীতিবিদরা গ্রোথের অঙ্ক কষেন, সে ভীষণ কঠিন অঙ্ক। ‘এ প্লাস বি হোলস্কোয়ার ইজ ইকুয়াল টু কলেজ স্কোয়ার’ – এর থেকেও কঠিন অঙ্ক। অঙ্কের জাদুতে ‘গ্রোথ’ দেখি আমরা, ‘উন্নয়ন’ দেখে ফেলি। মধ্যবিত্ত, বিদেশী ঋণের টাকায় তৈরী চওড়া রাস্তা, নিয়ন আলো, উড়ালপুল দেখতে দেখতে ঋণ করে কিনে ফেলা মারুতি চালিয়ে বাড়ি ফিরে ভারতীর কোলে মাথা রেখে আসন্ন রবিবারের মাল্টিপ্লেক্স আর শপিং মল দর্শনের পরিকল্পনা বানায়। কিন্তু অনেক অনেক ‘আম আদমির’ খিদে চাপার অক্ষম প্রচেষ্টা ঢাকা পড়ে যায় এই সব মেকি ‘গ্রোথ’ আর ‘উন্নয়নের’ তলায়।
বাস্তব এটাই যে ভোট যায় ভোট আসে, শাসক পালটায়, স্লোগানটাও পালটে যায় কিন্তু দরিদ্র মানুষ দরিদ্রই থাকে, বেকারত্ব থেকেই যায়। আর আমরা ভাবি, এবার হল না,পরের বার নিশ্চিত হবে! গেরুয়া না পারুক সবুজ পারবেই পারবে, না হলে লাল তো আছেই! বৃদ্ধ বিজ্ঞানী গ্যালিলিও চার্চের প্রবল চাপের মুখে ভেঙে পড়লেন। জনসমক্ষে ঘোষণা করলেন যে তিনি ভুল টলেমী ঠিক – পৃথিবী স্থির আর বাকি সব গ্রহ নক্ষত্র পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে! অপমানিত বিজ্ঞানী নতমস্তকে ঘোষণাটি করে ফিরে আসছেন, শুনতে পেলেন জন-অরণ্য থেকে কেউ একজন বলে উঠল, “হায় রে আমার অভাগা দেশ! তুমি বীরের জন্ম দিতে অক্ষম! ঐ দেখ পরাজয় স্বীকার করে ফিরে যাচ্ছে একজন কাপুরুষ”। নতমস্তক বৃদ্ধ মুখ তুলে স্মিত হেসে বললেন, “সত্যিই অভাগা সেই দেশ যেখানে এখনও বীরের প্রয়োজন হয়!”
আমার দেশ বীর খুঁজে ফিরছে, ৭০ বছর ধরে খুঁজছে মসিহা – উদ্ধারকর্তা! হে মোর জন্মভূমি তুমি সত্যিই অভাগা!