সিনেমার পর্দার রহস্য রোমাঞ্চও হার মানবে। মালদাকাণ্ডের পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে রহস্যের ঘন জাল। নিজের মা-বাবা-বোন-ঠাকুমাকে খুন করে নিজের বাড়ির মধ্যেই পুঁতে রেখেছিল আসিফ মহম্মদ। দাদা আরিফ মহম্মদের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করে কালিয়াচক থানার পুলিশ। শনিবার সকালে বাড়ির ভেতরে গুদাম থেকেই উদ্ধার হয় আসিফের পরিবারের চার সদস্যের দেহ। তদন্তে নেমে একের পর এক রহস্যের জট খুলতে গিয়ে বাড়িতে সিসিক্যামেরা থেকে গোপন সুড়ঙ্গও খুঁজে পান তদন্তকারীরা।
পুলিশ সূত্রে খবর, জেরায় নিজের পরিবারকে ঠাণ্ডা পানীয়ের মধ্যে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে অচৈতন্য করে জ্যান্ত অবস্থায় বাড়ির গোডাউনে কবর দিয়ে খুন করার কথা স্বীকার করেছে আসিফ। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে আসিফের দাদা আরিফের ভূমিকা নিয়ে। প্রায় চারমাস আগে নিজের মা-বাবাকে খুন করেছিল আসিফ। এতদিন পর কেন পুলিশের শরণাপন্ন হয় আরিফ তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, আসিফ ও আরিফ দুই ভাই বিশেষ কারুর সঙ্গে মেলামেশা করতেন না। প্রায়ই বলতেন তাঁরা কলকাতা চলে যাবেন। আরিফ কলকাতাতেই একটি কলেজে পড়াশোনা করেন। তাঁদের মা-বাবাও বলতেন সব কিছু ছেড়ে চলে যাবেন। কিন্তু, কোথায় যাবেন তা বলতেন না। আসিফের বাবা পরিবহন বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মাসছয়েক আগে নিজেদের বাড়ি ছাড়া বাকি জায়গা জমি বিক্রি করতে শুরু করেন আসিফ। সেই সময়তেই বাড়িতে নতুন করে গোডাউন বানানো শুরু হয়। তাই দেখে সন্দেহ প্রকাশ করেন প্রতিবেশীরা।
শুক্রবার আসিফের দাদা আরিফ কালিয়াচক থানায় গিয়ে নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে মা,বাবা, বোন ও ঠাকুমাকে খুন করার লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। সেই অভিযোগের ভিত্তিতেই গত রাতেই আসিফকে গ্রেফতার করে পুলিশ। শনিবার বাড়ির লাগোয়া গুদাম থেকেই চারজনের পচাগলা মৃতদেহ উদ্ধার হয়।
পুলিশ সূত্রে খবর, মাস ছয়েক আগেই প্রায় দেড় কোটি টাকার সম্পত্তি বিক্রি করে আসিফ। আসিফের ঘর থেকে উদ্ধার হয়েছে ল্যাপটপ, ফোন ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি। বাড়ির চারদিকে পাওয়া গিয়েছে সিসিক্যামেরাও। আরিফের অভিযোগ, তাঁকেও খুন করার চেষ্টা করেছিল আসিফ। কিন্তু তিনি কোনওরকমে পালিয়ে বাঁচেন। জেরায় আরিফ জানিয়েছেন, অনেকদিন ধরেই তাঁর ভাই বাড়িতে কারোর সঙ্গে মেলামেশা করত না। একা একা থাকত। এমনকী, তার ঘরে যেতেও বারণ করেছিল।
প্রাথমিকভাবে মানসিক অবসাদেই ভাই ভুগছে এমনটাই মনে করেছিলেন আরিফ। কিন্তু তিনি তখনও জানেন না, ভাই তাঁদের খুন করার চক্রান্ত করেছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি, বাবা,মা, বোন, ঠাকুমার সঙ্গে তাঁকেও ঘুমের ওষুধ মেশানো কোল্ডড্রিংক খাইয়েছিল আসিফ। তারপর জলে ডুবিয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করার চেষ্টা করেছিল। ভাইয়ের সঙ্গে মারপিট করে কোনওরকমে প্রাণ বাঁচিয়ে কলকাতায় চলে আসেন আরিফ। অভিযোগ, আসিফ তাঁর ফোন ট্যাপ করেছিল। কখন কোথায় তিনি যাচ্ছেন, সমস্ত গতিবিধিতে নজর রাখত আসিফ। ভয়ে পুলিশের কাছে যেতে পারেননি আরিফ। শুক্রবার, পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হচ্ছে বুঝতে পেরে ভাইয়ের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেন আরিফ।
যদিও, প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, গত চারমাসেও আরিফের সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎ হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সকলের সঙ্গে মোলাকাত করেছে আরিফ। এত বড় ঘটনা যে ঘটে গিয়েছে তার আঁচ পাননি কেউ।
তদন্তকারীদের অনুমান, আসিফের পারিবারিক সম্পত্তির মূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ টাকা দুই ভাই নিজেদের মধ্যেই বাঁটোয়ারা করতে চেয়েছিল। সেইজন্যেই পরিবারের বাকি সদস্যদের খুন করে তারা। কিন্তু পরে কোনওকারণে দুই ভাইয়ের মধ্যে মনোমালিন্য হওয়ার জেরে বাধ্য হয়েই পুলিশের শরণাপন্ন হয় আরিফ।