উত্তম কুমারের ‘মহানায়ক’ হয়ে ওঠার কাহিনি

Uttam Kumar occupies

NewsCaff :  উত্তম কুমার তার অভিনয়, নায়কোচিত সৌষ্ঠব ও তারকাদ্যূতিতে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ আসনটি দখল করে আছেন। ১৯২৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কলকাতায় এই মহান অভিনেতার জন্ম। ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই মাত্র ৫৩ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তার। বাংলা চলচ্চিত্রে প্রতিভাবান অভিনেতার অভাব নেই। কিন্তু মহানায়ক একজনই। তিনি উত্তম কুমার। হয়তো সে কারণেই সত্যজিৎ রায় তার ‘নায়ক’ চলচ্চিত্রে সাধারণ তরুণ থেকে চিত্রনায়ক হয়ে ওঠা অরিন্দম চ্যাটার্জির ভূমিকায় উত্তম ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতে পারেননি।

তবে তাঁর এই মহানায়ক হওয়ার জার্নিটা খুব স্মুথ ছিল না। উত্তম প্রথম সুযোগ পান ‘মায়াডোর’ নামে একটি ছবিতে। তবে ছবিটি শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়নি। নীতিন বোস পরিচালিত ‘দৃষ্টিদান’ মুক্তি পায় ১৯৪৮ সালে। এটি উত্তম অভিনীত প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি। এর পর ‘কার পাপে’ সহ কয়েকটি ছবিতে ছোট ছোট ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। দুয়েকটি ছবিতে নায়কও হয়েছিলেন। তবে কোন সিনেমাই ব্যবসা সফল হয়নি। ফলে তার নামই হয়ে যায় ‘ফ্লপ মাস্টার’। তিনি সেটে ঢুকলেই লোকজন ঠাট্টা তামাশা করতো তাকে নিয়ে। এ সময় অরুণ চ্যাটার্জি, অরুণ কুমার, উত্তম চ্যাটার্জি ইত্যাদি বিভিন্ন নামে অভিনয় করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উত্তম কুমার নামেই থিতু হন। ‘বসু পরিবার’ সিনেমায় এক যৌথ পরিবারের আদর্শবাদী বড় ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করে তিনি দর্শকদের দৃষ্টি কাড়েন। এ সিনেমায় সুপ্রিয়া দেবী ছিলেন তার ছোট বোনের ভূমিকায়। এটিই উত্তম-সুপ্রিয়া অভিনীত প্রথম ছবি।

‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে উত্তম প্রথম জুটি বাঁধেন নবাগতা সুচিত্রা সেনের সঙ্গে। ছবিটিতে তারা রোমান্টিক জুটির ভূমিকায় থাকলেও এর মূল অভিনেতা ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, তুলসী চক্রবর্তী, মলিনা দেবী। কমেডি সিনেমাটি ব্যবসাসফল হওয়ায় উত্তম কুমারের ভাগ্য খুলে যায়। ১৯৫৪ সালে আশাপূর্ণা দেবীর গল্প অবলম্বনে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ সিনেমায় উত্তম-সুচিত্রা জুটির পর্দা-রোমান্স দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। আর এ সিনেমার সঙ্গেই শুরু হয় উত্তম সুচিত্রা যুগের। ছবিটি দারুণভাবে ব্যবসা সফল হওয়ায় নায়ক উত্তম কুমারের আসন স্থায়ী হয়ে যায়। একের পর এক মুক্তি পায় উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেন অভিনীত সুপারহিট ছবি ‘শাপমোচন’, ‘শিল্পী’, ‘হারানো সুর’, ‘সাগরিকা’, ‘পথে হলো দেরী’, ‘ত্রিযামা’, চাওয়া পাওয়া, ‘সপ্তপদী’, ‘বিপাশা’, ‘ইন্দ্রাণী’, ‘সূর্য তোরণ’, ‘সবার উপরে’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ইত্যাদি।

সুপ্রিয়া চৌধুরী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, মাধবী মুখোপাধ্যায়সহ বিভিন্ন জনপ্রিয় নায়িকার বিপরীতে অসংখ্য ব্যবসা সফল ছবিতে অভিনয় করলেও সুচিত্রা সেনের সঙ্গে তার জুটি বাংলা ছবির ইতিহাসে সবচেয়ে রোমান্টিক জুটি বলে এখন পর্যন্ত বিবেচিত।তবে শুধু রোমান্টিক নায়ক নয়। অনেক ব্যতিক্রমী চরিত্রে অভিনয় করেছেন উত্তম যা তাকে অভিনেতা হিসেবে সার্থক প্রমাণিত করেছে। ধরা যাক অষ্টাদশ শতকের ফিরিঙ্গি কবি অ্যান্টনির কথা। ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছবিতে নাম ভূমিকায় ছিলেন উত্তম কুমার। এখানে তার বিপরীতে ছিলেন তনুজা। একজন কবির আবেগ, হতাশা, যন্ত্রণা, কবির লড়াইয়ে উত্তেজনা সবই সার্থকভাবে তুলে ধরেছিলেন উত্তম। কিংবা ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ ছবির উন্মত্ত যুবক থিরুমলের কথা বলা যায়। এখানে তার বিপরীতে ছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ অবলম্বনে নির্মিত সিনেমায় গৃহভৃত্য রাইচরণের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেন উত্তম। বিমল মিত্রের উপন্যাস নিয়ে ‘স্ত্রী’ ছবিতে লম্পট অথচ সরলমনা জমিদারের চরিত্রেও তিনি অনন্য। তিনি এখানে খলনায়ক হয়েও প্রধান ভূমিকায়। নায়কের ভূমিকায় ছিলেন সৌমিত্র চ্যাটার্জি। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘বিচারক’ অবলম্বনে নির্মিত সিনেমায় নাম ভূমিকায় ছিলেন উত্তম কুমার। বিচারকের মনোজগতের দ্বন্দ্ব সার্থকভাবে পর্দায় তুলে ধরেন তিনি।

উত্তম কুমার ২০২টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। এর মধ্যে ৩৯টি ছবি ব্লকবাস্টার হিট, ৫৭টি সুপারহিট ও ৫৭টি ছবি ব্যবসা সফল হয়েছে। শক্তি সামন্ত পরিচালিত উত্তম অভিনীত হিন্দি ছবি ‘অমানুষ’ ও ‘আনন্দ আশ্রম’ সুপারহিট হয়। এ দুটি ছবিতে তার বিপরীতে ছিলেন শর্মিলা ঠাকুর। সত্যজিৎ রায়ের ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সীর ভূমিকায় ছিলেন অসাধারণ। ‘চিড়িয়াখানা’ ও ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য সে বছর (১৯৬৭) তিনি সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পান। ১৯৬১ সালে ‘দোসর’ ছবিতে অভিনয়ের জন্যও সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পান। ‘হারানো সুর’, ‘হ্রদ’, ‘সপ্তপদী’, ‘নায়ক’, ‘গৃহদাহ’, ‘এখানে পিঞ্জর’, ‘অমানুষ’, ‘বহ্নিশিখা’ ছবির জন্য ৮ বার বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান। এছাড়াও তিনি অনেক সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার লাভ করেছেন।

উত্তম কুমার চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক হিসেবেও সাফল্য পান। ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’, ‘বনপলাশীর পদাবলী’, ‘শুধু একটি বছর’ সহ বেশ কয়েকটি ছবি তিনি পরিচালনা করেন। ‘উত্তর ফাল্গুনী’ সহ বিভিন্ন সফল ছবির প্রযোজকও ছিলেন তিনি। ‘কাল তুমি আলেয়া’ সিনেমার সংগীত পরিচালনাও করেন তিনি। ‘অগ্নিপরীক্ষা’র গল্প নিয়েই হিন্দিতে তিনি নির্মাণ করেন ‘ছোটিসি মুলাকাত’।

সিনেমার ব্যস্ততার পাশাপাশি মঞ্চেও অভিনয় করতেন। ‘শ্যামলী’ নাটকে দীর্ঘদিন অভিনয় করেছেন। ‘শ্যামলী’ অবশ্য চলচ্চিত্রও হয়েছিল। সেখানে নায়ক ছিলেন উত্তম এবং নায়িকা ছিলেন কাবেরী বসু। উত্তম কুমার সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কল্যাণে পরিচালিত বিভিন্ন কর্মদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।

উত্তম কুমার অভিনীত শেষ সিনেমা ‘ওগো বধূ সুন্দরী’। উত্তম কুমার ছিলেন বাঙালির প্রাণের নায়ক। স্বাভাবিক অভিনয় এবং নায়কোচিত গ্ল্যামার তার মধ্যে মিশেছিল সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছিল তার দৈহিক সৌষ্ঠব, সুন্দর চেহারা এবং অনাবিল হাসি।

Flamingo Media Share