NewsCaff : মহানায়ক উত্তম কুমার অভিনয় করেছেন প্রায় ২১২ টি চলচ্চিত্রে। ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই মাত্র ৫৩ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তার। মহানায়কের মৃত্যুবার্ষিকীতে তার অভিনীত সেরা ছবিগুলোর মধ্যে এমন ৫টি ছবি যেগুলি কাহিনি, চরিত্র, সংলাপ, পরিচালনা সব দিক থেকেই অসাধারণ। দেখে নেওয়া যাক সেই সিনেমাগুলি কী কী –
৫) হারানো সুর – ‘হারানো সুর’ মুক্তি পায় ১৯৫৭ সালে। পরিচালক ছিলেন অজয় কর। প্রযোজক ছিলেন উত্তমকুমার নিজেই। সংগীত পরিচালক ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। রেল দুর্ঘটনায় স্মৃতি হারায় ধনী ব্যবসায়ী অলোক মুখার্জি। তার চিকিৎসা করেন ডা. রমা ব্যানার্জি। অলোককে মানসিক হাসপাতাল থেকে উদ্ধার করে তিনি নিজের বাড়িতে নিয়ে যান এক প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলে। সেখানে তাকে বিয়ে করেন তিনি। পরে স্মৃতি ফিরে এল অলোক চলে আসেন কলকাতায় এবং ভুলে যান রমাকে। রমা কলকাতায় এসে অলোকের ভাগ্নির গভর্নেস হিসেবে কাজ নেন এবং বিভিন্নভাবে অলোকের স্মৃতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। সিনেমার শেষ পর্যায়ে রমাকে চিনতে পারেন অলোক। স্মৃতি হারানো এবং স্মৃতি ফিরে পাওয়ার পর অলোকের ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন অসাধারণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তোলেন উত্তম কুমার। উত্তম-সুচিত্রা জুটির অন্যতম সেরা ছবি ‘হারানো সুর’। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সংগীত ছিল অসাধারণ। ‘তুমি যে আমার’ গানে গীতা দত্ত এবং ‘আজ দুজনার দুটি পথ’ গানে কণ্ঠ দেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
৪) অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি – উনবিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে বাংলা ভাষার ফিরিঙ্গি কবি অ্যান্টনির জীবনভিত্তিক এ চলচ্চিত্রটিতে নাম ভূমিকায় অসামান্য অভিনয় করেন উত্তম কুমার। বাংলায় পিরিয়ডিকাল বায়োপিকের অন্যতম সেরা উদাহরণ এই ছবি। ১৯৬৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটির পরিচালক ছিলেন সুনীল ব্যানার্জি। সংগীত পরিচালনা করেন অনিল বাগচী। পর্তুগিজ বাবা ও বাঙালি মায়ের সন্তান হেনসমান অ্যান্থনি ছিলেন উনবিংশ শতাব্দির প্রথমদিকের একজন লোককবি যিনি অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি নামে পরিচিত ছিলেন। অ্যান্টনি এবং পেশাদার বাইজি শাকিলার প্রেমকাহিনি ও বিয়োগান্তক পরিণতি এ ছবির মূল উপজীব্য হলেও কবি হিসেবে অ্যান্টনির অন্তর্দ্বন্দ্ব, সামাজিক সংঘাত, হিন্দু সমাজের তৎকালীন সংকীর্ণতা সবই উঠে এসেছে এ ছবিতে। শাকিলার ভূমিকায় ছিলেন তনুজা এবং সমসাময়িক কবি ভোলা ময়রার ভূমিকায় অসিত বরণ অভিনয় করেন।
উত্তম কুমারের অভিনয়ের পাশাপাশি ছবিটির অন্যতম আকর্ষণ এর সংগীত। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও প্রণব রায়ের লেখা গানের সঙ্গে হেনসমান অ্যান্থনি, ভোলা ময়রা, ঠাকুর দাস সিংয়ের লেখা গান ব্যবহার করা হয়েছে এতে। মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে গানগুলো একই সঙ্গে সমালোচকদের প্রশংসা এবং বিপুল জনপ্রিয়তা পায়|। ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’, ‘আমি যে জলসা ঘরের’সহ বিভিন্ন বিখ্যাত গান রয়েছে ছবিতে। এ ছবিতে অভিনয়ের জন্য উত্তম কুমার ১৯৬৮ সালে বাংলা ভাষায় সেরা অভিনেতা হিসেবে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
৩) সপ্তপদী –
তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘সপ্তপদী’ মু্ক্তি পায় ১৯৬১ সালে। ছবিটির পরিচালক ছিলেন অজয় কর। প্রযোজক ছিলেন উত্তম কুমার।সংগীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ছবির নায়ক কৃষ্ণেন্দুর ভূমিকায় উত্তম কুমার এবং নায়িকা রিনা ব্রাউনের ভূমিকায় সুচিত্রা সেন ছিলেন অনবদ্য। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান রিনা ব্রাউনকে বিয়ে করার জন্য নিজের ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হন ডা. কৃষ্ণেন্দু। কিন্তু কৃষ্ণেন্দুর বাবার অনুরোধে রিনা তাকে প্রত্যাখ্যান করে এই যুক্তিতে যে, সাধারণ এক নারীর জন্য যে নিজের ধর্ম ত্যাগ করতে পারে সে অন্য কোনো নারীর জন্য যে রিনাকে ত্যাগ করবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়।
প্রত্যাখ্যাত কৃষ্ণেন্দু ধর্মযাজক হয়ে মানব সেবায় আত্মনিয়োগ করে। অনেক বছর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আবার দুজনের দেখা হয়। রিনা তখন নিজেই ধর্মের উপর বীতশ্রদ্ধ। আত্মজিজ্ঞাসা, মানসিক দ্বন্দ্ব, সমাজের ঘাত-প্রতিঘাত সবকিছু মিলিযে ছবিটি ক্ল্যাসিকের মর্যাদা পেয়েছে। এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য উত্তম কুমার শেক্সপিয়রের ‘ওথেলো’ নাটকটি রীতিমতো শিক্ষক রেখে পড়েন। ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ গানটিতে উত্তম-সুচিত্রার রোমান্টিক আবেদন অনবদ্য। এ ছবিতে অভিনয়ের জন্য মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সিলভার প্রাইজ পান সুচিত্রা সেন। ১৯৬১ সালে ছবিটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়।
২) সন্ন্যাসী রাজা –
ভাওয়ালের বরৌদি স্টেটের রাজা সূর্যকিশোর নাগচৌধুরী এবং তার রানি ইন্দুমতির জীবনের ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হয় ‘সন্ন্যাসী রাজা’। ১৯৭৪ সালে মুক্তি প্রাপ্ত ছবিটির পরিচালক ছিলেন পীযুষ বোস এবং সংগীত পরিচালক ছিলেন নচিকেতা ঘোষ। এখানে উত্তমের বিপরীতে ছিলেন সুপ্রিয়া দেবী। পুরীতে অবকাশ যাপনের সময় ভাওয়ালের রাজা সূর্যকিশোরকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন তার গৃহ চিকিৎসক। চিকিৎসককে সহায়তা করেন রানি ইন্দুমতি। ঘটনাচক্রে রাজার মৃত্যু হয় না। একদল সন্ন্যাসী তাকে উদ্ধার করে। কিন্তু তার স্মৃতি লোপ পায়। পরবর্তীতে স্মৃতি ফিরে এলে সন্ন্যাসীবেশে রাজা ফিরে আসেন তার এলাকায়। রাজার জমিদারির মালিকানা নিয়ে শুরু হয় মামলা।ব্রিটিশ আমলে এটি ছিল একটি চাঞ্চল্যকর মামলা। এখানে বিলাসী ও উদার হৃদয় রাজা এবং পরবর্তীতে সন্ন্যাসীর ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেন উত্তম কুমার।
১) নায়ক – উত্তম কুমার অভিনীত সেরা ছবিটির নাম নিঃসন্দেহে ‘নায়ক’। এ ছবির পরিচালক সত্যজিৎ রায়। এর কাহিনি, চিত্রনাট্য, সংগীত পরিচালনাতেও ছিলেন সত্যজিৎ রায়।‘নায়ক’ ছবিতে উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম অরিন্দম চ্যাটার্জি। তিনি একজন জনপ্রিয় চিত্রনায়ক। তার মানসিক টানাপড়েন, উচ্চাশা, কখনও স্বার্থপরতা, কখনও নীতির সঙ্গে আপোষ, শিল্পবোধ ও অর্থচিন্তার দ্বন্দ্ব এসব নিয়েই গড়ে উঠেছে সিনেমার কাহিনি।
একজন নায়কের কেবল সুঅভিনেতা চলে না। রূপ, ব্যক্তিত্ব এবং চটক্ও থাকা চাই, সেই সঙ্গে নায়কসুরভ ম্যানারিজমও থাকা প্রয়োজন। সেদিক থেকে বাংলা চলচ্চিত্রে উত্তম কুমারের বিকল্প কাউকে ভাবতে পারেননি সত্যজিৎ রায়। ছবিটির প্রযোজক ছিলেন আর ডি বনশল। আরও অভিনয় করেছিলেন শর্মিলা ঠাকুর, বীরেশ্বর সেন, সোমেন বোস প্রমুখ। ১৯৬৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘নায়ক’ ১৯৬৭ সালে সেরা বাংলা চলচ্চিত্র হিসেবে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। ১৯৬৭ সালে আন্তর্জাতিক বডিল অ্যাওয়ার্ড পায় বেস্ট নন ইউরোপিয়ান ফিল্ম হিসেবে। ১৯৬৬ সালে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ড পায়। ওই উৎসবে ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ডও পায় ছবিটি। বেঙ্গলি ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন সেরা পরিচালক হিসেবে সত্যজিৎ রায় এবং সেরা অভিনেতা হিসেবে উত্তম কুমারকে পুরস্কৃত করে এ ছবির সুবাদে।